হোমিওপ্যাথিক ক্রনিক ডিজিজ আলোচনা- হ্যানিম্যান তাঁর ক্রনিক ডিজিজ (Chronic Disease)গ্রন্থে ক্রনিক রোগ আলোচনা করতে গিয়ে ক্রনিক ডিজিজ (Chronic Disease) শব্দটির দ্বারা যে চির বুঝাননি তা আমরা বুঝতে পারি তখন,যখন আমরা তাঁর এ গ্রন্থে উল্লিখিত ক্রনিক রোগগুলো অধ্যয়ন করে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করি।
ক্রনিক ডিজিজ বলতে কি বুঝিয়েছেন ?
হ্যানিম্যান ‘Chronic Disease’বলতে ঐ সমস্ত রোগগুলোকে বুঝিয়েছেন যে রোগগুলোর দ্বারা কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তাকে সারা জীবন ঐ রোগে ভুগতে হয় কিন্তু যথা সময়ে সঠিক হোমিওপ্যাথিক নীতিতে চিকিৎসা দিলে এ রোগী অরোগ্য হয় অর্থাৎ রোগীর মধ্যে অবস্থিত রোগটি বিতাড়িত হয়।‘Chronic’ শব্দটিকে হ্যানিম্যান তাঁর‘Chronic Disease’ গ্রন্থে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন যেখানে ডা. চ্যাটার্জী অনুবাদ করতে গিয়ে ক্ষুদ্র অর্থে ব্যবহার করেছেন।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রনিক শব্দটিকে চির না বলে ক্রনিক বলাই উত্তম। আবার দেখা যায় ডা. চ্যাটার্জী গ্রন্থটির শিরোনামের অনুবাদকালে ডিজিজকে রোগ বলেই অভিহিত করেছেন কিন্তু গ্রন্থটির ভিতরে অনুবাদ করতে গিয়ে যেখানে যেখানে হ্যানিম্যান ‘Disease’ ও ‘Chronic’ শব্দগু লি ব্যবহার করেছেন সেখানে সেখানে ডা. চ্যাটার্জী যথাক্রমে রোগবীজ ও প্রাচীন বলেছেন।
যেমন:‘Nature of Chronic Diseases ’ অধ্যায়ে হ্যানেম্যান বলেছেন, ‘Psora is the oldest miasmatic chronic disease.’ যাকে বাংলা অনুবাদ করে ডা. চ্যাটার্জী লিখেছেন, ‘সোরা সবচেয়ে প্রাচীন সূক্ষ্ম চিররোগবীজ’অথচ ইংরেজী এ বাক্যটির বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিৎ ছিল, ‘সোরা হচ্ছে সবচেয়ে পুরাতন মায়াজম্যাটিক ক্রনিক রোগ’। ইংলিশ টু বেঙ্গলী কোন ডিকশনারীতেই ‘disease’ শব্দটির অর্থ ‘রোগবীজ’ পাওয়া যায়না, যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে রোগ, অসুস্থতা, অসুখ, ব্যাধি, ব্যামো, ব্যারাম ইত্যাদি।
‘রোগ’ শব্দটিই সর্বস্তরে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দ। তারপরও ডা. চ্যাটার্জি ‘Miasm’কে রোগ না বলে কেন রোগবীজ বলেছেন তা বোধগম্য নয়। ডা. জি. দীর্ঘাঙ্গী, ডা. হরিমোহন চৌধুরী ও ডা. ত্রিগুণানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেই হ্যানিম্যানের ‘Organon of Medicine’ গ্রন্থটির বাংলায় অনুবাদ করেছেন এবং প্রত্যেকেই গ্রন্থটির শিরোনামটিকে অনুবাদ করে লিখেছেন, ‘অর্গানন’ অথচ শিরোনামটির বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত ছিল, ‘অর্গানন অভ্ মেডিসিন’। ঠিক একই ভাবে আমরা দেখতে পাই, হ্যানিম্যান ‘Organon of Medicine’ গ্রন্থের যে সব জায়গায় ‘Miasm’ এবং ‘Miasmatic Chronic Disease’ ইত্যাদি শব্দগুলো উল্লেখ করেছেন।

হোমিওপ্যাথিক ক্রনিক ডিজিজ কে ‘দোষ’ এবং ‘সূক্ষ্ম চির রোগবীজ’বলে উল্লেখ করেছেন কেন?
উপরোক্ত প্রত্যেক চিকিৎসক মহোদয়ই ঐ শব্দগুলোকে যথাক্রমে ‘দোষ’ এবং ‘সূক্ষ্ম চির রোগবীজ’বলে উল্লেখ করেছেন। ডা. নীলমনি ঘটক যিনি বাংলার কেন্ট নামে পরিচিত তিনি এবং তাঁর সুযোগ্য জামাতা ডা. এম. ভট্টাচার্য, ডা. নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডা. বিজয় কুমার বসু প্রমুখ বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ প্রত্যেকেই তাঁদের বাংলায় লিখিত গ্রন্থগুলোতে মায়াজমগুলোকে দোষ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
উল্লিখিত প্রত্যেক চিকিৎসকই আমাদের অত্যন্ত সম্মানের পাত্র কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের জন্য হোমিওপ্যাথির উন্নয়নে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁরাও ভুলের উর্ধ্বে নন। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এতগুলো বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মধ্যে সবারই ভুল হলো ? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, যা ভুল তা যদি দুনিয়ার সব মানুষেও সমর্থন করে তারপরও তা ভুল, আর যা সঠিক তা যদি দুনিয়ার একজন মানুষও সমর্থন না করে তারপরও তা সঠিক।
অনেক শব্দ আছে যেগুলোকে ইংরেজী থেকে বাংলায় কিংবা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ না করাই ভাল। উপরোক্ত চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই মহৎ ছিল এতে কোনই সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁদের অনুবাদকৃত অল্প কিছু মৌলিক শব্দ সাধারণ চিকিৎসকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে হোমিওপ্যাথি চর্চা করতে গিয়ে তাঁরা হোমিওপ্যাথি মতে রোগ কি বা কোনগুলো তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন যে কারণে হোমিওপ্যাথ হিসেবে সফলতার মুখ তাঁরা দেখার সুযোগ পান না। যেখানে হ্যানিম্যান মায়াজমগুলোকে রোগ হিসেবে জানেন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগও দেখিয়েছেন সেখানে এ সমস্ত চিকিৎসকগণ কেন দোষ হিসেবে জানেন তা আমাদের অজানা।
Read More:হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি ঔষধ চেনা
বর্তমান কালের যে সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ মায়াজমগুলোকে রোগ হিসেবে মেনে নিতে রাজী নন তাঁদের মধ্যে অনেকেই উপরোক্ত গ্রন্থগুলো যেগুলো থেকে উদ্ধৃতিগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো পড়েন ঠিকই, কিন্তু পড়লেও ‘Organon of Medicine’, ‘Chronic Disease’, ইত্যাদি গ্রন্থগুলো পড়েন না, পড়েন ঐ সমস্ত গ্রন্থগুলোর বিতর্কিত বাংলা অনুবাদ। ফলে প্রকৃত তথ্য ও তত্ত্ব হতে তাঁরা বঞ্চিত হন, হোমিওপ্যাথির প্রকৃত ধারণা তাঁদের কাছে ধরা দেয়না, মায়াজমগুলো তাঁদের কাছে দোষ হিসেবেই থেকে যায়, রোগ হিসেবে নয়।
তাঁরাও এ দোষগুলো সম্পর্কে আর বেশী কিছু জানার প্রয়োজন মনে করেন না। কারণ, দোষের তো কোন সাধারণ ‘Sign’ এবং ‘Symptom’ থাকেনা। কিন্তু যদি রোগ হিসেবে জানতেন তাহলে তাঁরা ‘Chronic Disease’ নামক যে গ্রন্থটিতে হ্যানেম্যান তিনটি রোগের অদ্ভূত প্রকৃতি ও তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন সে গ্রন্থটিকে হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিস অভ মেডিসিন হিসেবে মেনে নিতে পারতেন এবং ঐ গ্রন্থে আলোচিত রোগগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানার চেষ্টা করতেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উপরোক্ত এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার উপায় কি? উপায় অবশ্যই আছে। জে. হেনরি অ্যালেনও তাঁর সমসাময়িক চিকিৎসকদের মধ্যে হোমিওপ্যাথির ভুল ব্যাখ্যা এবং ভুল চর্চা লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাঁর ‘The Chronic Miasms’ গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলেছেন, ‘As our institutions are, so are our people’
অর্থাৎ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যে রকম, আমাদের জনগোষ্ঠিও সে রকম। এখানে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের শিক্ষকগণ যে রকম হবেন সেরকমই তো হবে আমাদের শিক্ষার্থীবৃন্দ। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে শুধুমাত্র তাই শেখাতে পারি যা আমাদেরকে শিখানো হয়েছে। আমরা আমাদের রোগীদেরকে সেভাবেই আরোগ্য করতে পারি যেভাবে আরোগ্য করতে আমাদেরকে শিখানো হয়েছে। সুদূর হ্যানেম্যানের সময়ও হোমিওপ্যাথির ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল চর্চা ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
কিন্তু একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক অবশ্যই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদেরকে যা শিখানো হয়েছে শুধূমাত্র তার উপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবেনা, সঠিক হোমিওপ্যাথি কি তা আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য আমরা যারা হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথির ধারক ও বাহক হতে চাই তাদের দায়িত্ব হচ্ছে হ্যাম্যিানের আদর্শ ও নির্দেশকে আকড়ে ধরা এবং তাহলে আর লক্ষ্যচ্যুত হবার সম্ভাবনা নেই।
উপরোক্ত সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার একটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে হ্যানিম্যানের ‘Organon of Medicine’, ‘Chronic Disease’ ইত্যাদিসহ হ্যানিম্যনের সমস্ত গ্রন্থগুলো ইংরেজী ভাষাতেই অধ্যয়ন করে হোমিওপ্যাথির মৌলিক বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে জেনে নেয়া।
কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে উপরোক্ত গ্রন্থগুলো ইংরেজীতেই পড়তে হবে, তার কারণ কি?
এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, গ্রন্থগুলোর সঠিকভাবে বাংলায় অনুদিত উন্নতমানের কোন বই আজ পর্যন্ত মার্কেটে পাওয়া যায়নি। আর একটি বিশেষ কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক জ্ঞানার্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষাই দরকার হয়। হোমিওপ্যাথি শুধুই যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বিস্তৃত একটি চিকিৎসা শাস্ত্র তা নয় পৃথিবীর চিকিৎসা শাস্ত্রগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা শাস্ত্রও বটে। কাজেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রকে আয়ত্ত করতে হলে আন্তর্জাতিক ভাষাতেই তাকে অধ্যয়ন করতে হবে। [Version-88]
লেখক: পরিচিতি ডা.হাবিবুর রহমান, ডি.এইচ.এম.এস.(ঢাকা),
রেজি.২৩৮৬১,বি.এ.অনার্স(ইংলিশ),এম.এ.(ইংলিশ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
চ্যাম্বার: সিটি হোমিও হল,
Cell: 01736757306.01736181642.
2 thoughts on “হোমিওপ্যাথিক ক্রনিক ডিজিজ আলোচনা”
Comments are closed.